ঢাকা,শুক্রবার, ১৫ নভেম্বর ২০২৪

বাংলাদেশের মানচিত্র থেকে হারিয়ে যাচ্ছে শাহপরীরদ্বীপ !

20150810_143744_1জসিম মাহমুদ, টেকনাফ :

১৯৭০ সালে শাহপরীর দ্বীপে বেড়িবাধ নির্মাণ করা হয়েছিল। এরপর ৪৫ বছর পার হলেও বেড়িবাধটি পূন:নির্মাণ করা হয়নি। তবে ১৯৯৪ সালের ঘূর্ণিঝড় হ্যারিকেনের পর বেড়িবাধটি সংস্কার করা হয়েছিল। এরপর থেকে তেমন ভাবে সংস্কারও হয়নি।ফলে এই সময়ে সাগরেরর অতলে হারিয়ে গেছে দ্বীপটির প্রায় দুই-তৃতীয়াংশের বেশী। সর্বস্ব হারিয়ে সেই থেকে এলাকা ছেড়েছে ৫ হাজার পরিবার। তারপরও সেটি যথাযথ সংস্কারে উদ্দ্যেগ নেয়নি সংশ্লিষ্টরা।

পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্রে জানা যায় , ১৯৭০ সালে শাহপরীরদ্বীপের সাগর ও নাফ নদীকে ঘিরে পচিশ কিলোমিটার বেড়িবাধ নির্মাণ করা হয়। ১৯৯১ সালের ২৯ এপ্রিল ঘূর্ণিঝড়ের আঘাতে শাহপরীর দ্বীপের দক্ষিণ-পশ্চিমের ৬৮ নাম্বার ফোল্ডারে বেড়িবাধের প্রায় ২০০মিটারের একটি অংশ ভেঙ্গে যায়। এরপর ১৯৯৪সালের ৩ মে ঘূর্ণিঝড় হ্যারিকেনের আঘাতে দ্বীপের পূর্ব ও পশ্চিম অংশে প্রায় দুই কিলোমিটার ভেঙ্গে যায়। ১৯৯৬ সালে বাধটিকে আবারো ভালোভাবে মেরামত করা হয়। ফিরিয়ে দেওয়া হয় তার পূর্ণাকৃতি। গত ১৯ বছর পর্যন্ত ওই বাধটি তেমনভাবে আর সংস্কার করা হয়নি।

শাহ পরীর দ্বীপ বাহারুলউলুম বড় মাদ্রাসার প্রধান পরিচালক হোসেন আহম্মদ বলেন, ৯৬ সালের পর দ্বীপের বাধটি তেমন ভাবে সংস্কার হয়নি। শুধুমাত্র কিছু অংশে কিছুটা কাজ হতো । তাও বর্ষা মৌসুমের শুরুর দিকে। ফলে বর্ষাকালেই ওই বাধ আবার ভেঙ্গে যায়। এভাবেই চলছে বছরের পর বছর। তিনি আরও জানান, এ দ্বীপ থেকে ঘর-বাড়ি হারিয়ে প্রায় পাচঁ হাজারের মত পরিবার অন্যত্রে আশ্রয় নিয়েছেন। পাউবো সূত্রে জানা গেছে, ১৯৯৬ সালে প্রায় ৮০ কোটি টাকার ব্যয়ে জালিয়াপাড়া থেকে কাটাবুনিয়া পর্যন্ত গ্রাম রক্ষা বাধ নির্মাণ করা হয়। তবে অনিয়ম ও দূর্ণীতির কারণে সে গ্রাম রক্ষা বাধও টিকেনি বেশীদিন। বেড়িবাধটি মেরামত করা হয়। এরপর ২০০৮ সালে ৪ কোটি ৪২ লাখ টাকা, ২০১০ সালে ৪ কোটি ৭৫ লাখ, ২০১১ সালে ৭ কোটি ২১লাখ টাকা, ২০১৩ সালে ৮৩ লাখ ও ২০১৪ সালে ৫৫ লাখ টাকা ব্যয় করা হয়েছে। কিন্তু সময়পোযুগী ও যুগোপযোগী কাজ না হওয়ায় গত ৪ বছর যাবৎ শাহপরীর দ্বীপের সাগরের পাশের প্রায়ই ২৬৪৫ মিটার বেড়িবাধ ভেঙ্গে গেছে। এছাড়া হুমকির মুখে রয়েছে সাগরের পাশের বেড়িবাধের আরো ৭ কিলোমিটার।

শাহপরীর দ্বীপ রক্ষা কমিটির সাধারণ সম্পাদক আবুল হাশেম জানান, প্রতিবছর ভাঙনে এলাকার মানুষ হারাচ্ছে বসতভিটি ও জমিজমা। নিঃস্ব হচ্ছে হাজারো পরিবার। গত তিন বছর ধরে জোয়ারের পানি প্রবেশ করায় প্রায় দুই হাজার একর জমিতে লবণ চাষ বন্ধ রয়েছে। সাগরের লোনা জলে হারিয়ে গেছে প্রায়ই ৮ হাজার একর জমি। শাহপরীরদ্বীপ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক কলিম উল্লাহ জানান, শাহপরীরদ্বীপের বাধঁ আর কখনো হবে কিনা জানিনা । এইটা জানি এই বাধঁ আগামী বছরের মধ্যে মেরামত না হলে শাহপরীর দ্বীপের বসবাসকারিদের এই দ্বীপ ছেড়ে চলে যেতে হবে। সাবরাং ইউনিয়ন পরিষদ সূত্র জানায়,২০১২ সালের ২২ জুলাইয়ের প্রবল জোয়ারে শাহপরীরদ্বীপের পশ্চিমপাড়ার বেড়িবাধের একাংশ ভেঙ্গে যায়। ওই মাসেই ভেঙ্গে যায় ডাঙ্গর পাড়া,দক্ষিণ পাড়া, মাঝের পাড়া ও গোলাপাড়ার আরেকটি অংশ। সবমিলিয়ে প্রায় ২৬৪৫ মিটার বেড়িবাধ এখনো পর্যন্ত ভাঙ্গা। আর সেই থেকে সাগরের লোনা জলে বিলীন হয়েছে ওই দ্বীপের ৮ হাজার একর জমি। সমুদ্রের করাল গ্রাসে সর্বস্ব হারিয়ে দ্বীপ ছেড়েছে প্রায় ৩ হাজার লোকজন। বেড়িবাধ না থাকায় জোয়ারের পানিতে নষ্ট হয়ে গেছে দ্বীপটির সাথে যোগাযোগের একমাত্র রাস্তার প্রায় সাড়ে ৫ কিলোমিটার। আর রাস্তা না থাকার কারণে শাহপরীরদ্বীপ জেটিঘাট অনেকে ব্যবসায়ী গুটিয়ে নিয়েছে নিজেদের ব্যবসা বানিজ্য।

সাবরাং ইউনিয়নের ৭ নং ওয়ার্ডের মেম্বার নুরুল আমিন জানান, শাহপরীরদ্বীপের পশ্চিমপাড়া,মাঝের পাড়ার ও দক্ষিণ পাড়া প্রায় ৫ হাজার লোক ভিটেমাটি ছেড়ে চলে গেছে। এমনকি তিনি নিজেও পশ্চিমপাড়ার বাসিন্দা হলেও এখন থাকেন অন্যখানে। কারণ তার বসতবাড়ি সাগরে বিলীন হয়ে গেছে। শাহপরীর দ্বীপ সরেজমিন পরিদর্শন করে দেখা যায়, জোয়ারের পানিতে ডুবে গেছে টেকনাফ- শাহপরীর দ্বীপ সড়ক। ১৩ দশমিক ৭ কিলোমিটারের পাকা সড়কটির সাড়ে পাঁচ কিলোমিটার ডুবে রয়েছে পানিতে। এ ডুবে থাকা সড়ক দিয়ে দ্বীপের মানুষ প্রায় তিন বছর ধরে একমাত্র নৌকা নিয়ে চলাচল করে থাকে। আবার সন্ধ্যার পর নৌকা চলাচল বন্ধ থাকে। এই রুটে র্দূঘটনায় প্রাণ গেছেন দুই ছাত্রের। টেকনাফের সাথে সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন শাহপরীর দ্বীপের। জোয়ারের পানিতে ডুবন্ত সড়কটির দুই পাশে কয়েক শ একরের লবণ মাঠেও পানি।শাহপরীরদ্বীপে ৪০ হাজার মানুষ চিকিৎসা সেবা থেকে বঞ্চিতঃ জরুরী ভিক্তিতে স্বাস্থ্য ক্লিনিক স্থাপনের দাবী। সাগরের ভাংগন কবলিত শাহপরীরদ্বীপের প্রায় ৩০ হাজার মানুষ মৌলিক নাগরিক অধিকার চিকিৎসা থেকে একেবারে বঞ্চিত। গত ৫ বছর সর্ব দক্ষিণ সীমান্ত জনপদ এবং মৎস্য সম্পদের জন্য খ্যাত শাহপরীরদ্বীপ সাগরের ভাংগনের এ দ্বীপটি দেশের মূলভূখন্ড থেকে একেবারে বিচ্ছিন্ন হয়ে হড়ে। জোয়ার ভাটার উপর নির্ভর এবং নৌ-পথ ছাড়া শাহপরীরদ্বীপবাসির বিকল্প কোন পথ নেই। সাবরাং ইউনিয়নের অংশ বিশেষ ১২টি পাড়া নিয়ে এই শাহপরীরদ্বীপ। এ দ্বীপের অধিকাংশ মানুষ মধ্যপ্রাচ্য থেকে প্রচুর পরিমাণ রেমিটেন্স আসছে। শাহপরীরদ্বীপ রক্ষাকারী বেড়িবাঁধ ভাংগন এবং উপকূলীয় বনায়ন নিধনের ফলে এ দ্বীপের উপর প্রভাব পড়ে প্রাকৃতিক দূর্যোগের অশনি সংকেত। তাই পৌর দ্বীপ বাসির নানা ঝুঁকিতে বসবাস করে আসছে।

সমপ্রতি এ প্রতিবেদক সরেজমিনে শাহপরীরদ্বীপ পরিদর্শন করে জানা যায়- দ্বীপের বসবাসরত মানুষ চিকিৎসা সংকটের মধ্যে ভোগছেন। এখানে সরকারী চিকিৎসা দেওয়ার মত কোন প্রতিষ্টান এবং ব্যবস্থা না থাকায় তারা স্থানীয় পল্লী চিকিৎসকের উপর নির্ভরকরে চিকিৎসা নিতে বাধ্য হচ্ছে। বিশেষকরে ডেলিভারী বা প্রসুতি রোগী চরম ঝুঁকিতে রয়েছে। ডেলিবারী চিকিৎসা নিতে টেকনাফ সদর হাসপাতালে আসতে পারেনা। আসলেও মাঝ পথে রোগীর ডেলিবারি হচ্ছে বলে জানা যায়। প্রায় জোয়ারের পানিতে ডুবে গেছে টেকনাফ- শাহপরীর দ্বীপ সড়ক।। তাই জনস্বার্থে সেখানে জরুরী ভিত্তিতে সরকারী স্বাস্থ্য ক্লিনিক স্থাপন ও ডাক্তার নিয়োগ নিতান্ত প্রয়োজন বলে দ্বীপের সচেতন মহলের দাবী উঠেছে। প্রধানমন্ত্রী ও স্বাস্থ্যমন্ত্রীর ঘোষনা অনুযায়ী দেশের প্রতিটি ইউনিয়নের সরকারী এম,বিবি,এস ডাক্তার নিয়োগ দেওয়ার কথা থাকলেও এ জন গুরুত্বপূর্ণ ঘোষনাটি উপেক্ষিত রয়েছে। প্রত্যান্ত অঞ্চলের লোকেরা সরকারী চিকিৎসা সেবা থেকে একেবারে বঞ্চিত। ফলে তারা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে উপজেলা হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে বাধ্য হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে তাদের প্রচুর অর্থ ব্যয় হচ্ছে বলে ভূক্তভোগী রোগীরা জানায়। খোঁজ নিয়ে জানা যায়- সাবরাং ইউনিয়ন কমপ্লেক্সে ডাক্তার এবং অন্যান্য কর্মকর্তাদের জন্য অফিস বরাদ্ধ থাকলেও তারা এখানে না থেকে পৌর শহরে অবস্থান করছেন এবং জনগন এসব সুযোগ সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন।

 

পাঠকের মতামত: